দীক্ষা (মোহাম্মদ নাসির আলী)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - আনন্দপাঠ - | NCTB BOOK
226
226

স্কুলে বরাবর বাংলা পড়ান সতুবাবু- সতীনাথ বোস। তিনি সেদিন গরহাজির। হেডমাস্টার মশাই তাই মৌলবি সাহেবকে ডেকে বললেন, 'সতুবাবু আজ আসেননি দেখছি! ফোর্থ ক্লাসে আজকে বাংলার পিরিয়ডটা আপনিই কোনো রকমে চালিয়ে দিনগে, কেমন?'

'জি, আচ্ছা।' বলে মৌলবি সাহেব রাজি হয়ে গেলেন। রাজি হলেন সত্যি কিন্তু মনে-মনে প্রমাদ গুনলেন। একে তো পড়াতে হবে বাংলা, তা-ও আবার ফোর্থ ক্লাসে অর্থাৎ দুষ্টের শিরোমণি লেবুদের ক্লাসে।

মৌলবি সাহেব সরল গোবেচারি গোছের লোক। ধর্মপ্রাণ এই নিরীহ লোকটিকে স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র প্রায় সবাই ভক্তিশ্রদ্ধার চোখে দেখত, তা ছাড়া একটু ভয়ও করত। ভয়ের কারণ, স্বয়ং হেডমাস্টার মশাইও মৌলবি সাহেবকে সমীহ করে চলতেন। অনেক কাজেই তিনি মৌলবি সাহেবের পরামর্শ নিতেন।

কিন্তু মৌলবি সাহেব নিজে মনে-মনে ভয় করতেন লেবুকে। ফোর্থ ক্লাসে ফারসি পড়াতে গিয়ে লেবুর নিত্যনতুন উৎপাতের জ্বালায় তিনি অস্থির থাকেন। তার ওপর আজ আবার পড়াতে হবে বাংলা। গোলমাল এড়ানোর জন্য তিনি তাই ক্লাসে ঢুকেই এক বুদ্ধি আঁটলেন। বললেন, 'আজকে ক্লাসে সংক্ষিপ্ত একটি রচনা লিখতে দিচ্ছি তোমাদের; মনে করো, পাঁচশো করে টাকা দিলাম তোমাদের সবাইকে। সেই টাকা দিয়ে কে কী করবে লিখে দেখাও। কোনোরকম গোলমাল করবে না, আগেই বলে রাখছি।'

খাতা-পেনসিল নিয়ে রচনা লিখায় মনোযোগ দিল সবাই। লেবু এককোণ থেকে উঠে বলল, 'পাঁচশো করে প্রতিজনকে দিলে সে যে অনেক টাকার ব্যাপার, স্যার। দু-পাঁচ হাজারেও কুলোবে না! এত টাকা দিয়ে ফেলবেন স্যার? কিছু কমিয়ে দিলেই তো ভালো।'

লেবুর এ অবান্তর উক্তিতে মৌলবি সাহেব মনে-মনে রেগে গেলেন। বাইরে তা প্রকাশ না-করে বললেন, 'যাকে বলে হোপলেস ছেলে, তুমি হয়েছ তা-ই। বললেই কি আর দেওয়া হলো? বললাম তো, মনে করে নাও পাঁচশো করে টাকা তোমরা পেলে।'

'ওহো, তা-ই বলুন, মনে করতে হবে পাঁচশো করে টাকা আপনি দিলেন, বেশ।' বলেই লেবু এক-মিনিটে কী যেন লিখে খাতা উলটে রাখল। মৌলবি সাহেবের তা দৃষ্টি এড়াল না।

ঘণ্টা বাজবার আগেই সবার রচনা লেখা শেষ হলো। মৌলবি সাহেব খাতা দেখতে লাগলেন। কেউ লিখেছে, টাকা পেয়ে ব্যবসা করবে, কেউ দান করবে। কেউ-কেউ লিখেছে, গাঁয়ে স্কুল করে দেবে, গরিব ছেলেমেয়েরা সেখানে বিনা বেতনে পড়বে। কিন্তু লেবু লিখেছে চমৎকার। দু-চার কথায় রচনা তার শেষ। লিখেছে, 'কম টাকা হইলে বিশেষ চিন্তাভাবনা করিয়া খরচ করিতাম। পাঁচশত টাকা পাইলে নিশ্চিন্তে পায়ের ওপর পা তুলিয়া বসিয়া খাইব।'

এবার আর মৌলবি সাহেব রাগ চেপে রাখতে পারলেন না। লেবুর কান টেনে দিয়ে বললেন, 'খাওয়াচ্ছি তোমাকে পায়ের ওপর পা তুলে। এসব কী লিখেছ, হোপলেস কাঁহাকা'- বলেই পিঠের ওপর দু ঘা বসাতে যাবেন, এমন সময় দফতরি এল একটা নোটিশ নিয়ে। হেডমাস্টারের নোটিশ- টিফিনের ঘণ্টা শুরু হলে পাঁচ মিনিটের জন্য সবাইকে হাজির হতে হবে কমনরুমে।

লেবুকে রেহাই দিয়ে মৌলবি সাহেব ছেলেদের নোটিশের মর্ম বুঝিয়ে দিলেন।

টিফিনের ঘণ্টায় প্রায় সবাই এসে জড়ো হলো কমনরুমে। হেডমাস্টার মশাই বলতে লাগলেন, 'চণ্ডীতলা ঘোষেদের বাড়ির পাঠশালার বৃদ্ধ পণ্ডিতমশাই বামাপদবাবুকে তোমরা সবাই জানো, আশা করি। তোমাদের অনেকেই তাঁর ছাত্র। তাঁর পাঠশালায় পড়ে এখানে এসেছ। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, তিনি তোমাদের নামে আজ এক গুরুতর অভিযোগ করে পাঠিয়েছেন। তোমরা নাকি তাঁর ছাত্রদের অহেতুক ঠাট্টাবিদ্রূপ করো। তার নমুনাও তিনি পাঠিয়েছেন। পাঠশালার দেয়ালে কে যেন ছাত্রদের নামে খড়ি দিয়ে লিখে রেখেছে:

বামা পণ্ডিতের পাঠশালা
বিদ্যে হয় না কাঁচকলা-
দুহাতে দুই কলম দিয়ে
বসিয়ে রাখে গাছতলা।

অভিনব এ ছড়া শুনে ছাত্ররা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। হেডমাস্টার আবার বললেন, 'আমার দৃঢ় ধারণা, এ ছড়ার রচয়িতা তোমাদের ভেতরই রয়েছে। কে সেই কবিবর তা স্বীকার করলে কিছুই আমি বলব না তাকে, শুধু ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেব। তা না-হলে বুঝতেই পারছ, অপরাধীকে বের করে কঠিন সাজার ব্যবস্থা করতেই হবে আমাকে।'

তিনি চুপ করলেন। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এমন সময় মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল লেবু। বলল, 'এ অন্যায় কাজ আমিই করেছি স্যার। অন্যায় বলে তখন বুঝতে পারিনি।'

কার যে এ কাজ হেডমাস্টার মশাই আগেই তার কিছুটা আঁচ করে রেখেছিলেন। অনুমানটা তাঁর সত্যিই হয়েছে দেখা গেল। এবার তিনি বললেন, 'অন্যায় করেছ এবং তা স্বীকার করবার সৎসাহস তোমার আছে দেখে এবার আমি কিছুই বললাম না। গুরুজনদের নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করা খুবই অন্যায়, বুঝতেই পারছ। কাজেই বলে রাখছি, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অন্যায় তোমরা করেছ বলে শুনতে না পাই। আর হ্যাঁ, আরেকটা কাজ তোমাকে করতে হবে। কালকে স্কুলে আসবার পথে পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসতে হবে তোমাকে। পারবে তো?'
'খুব পারব স্যার।'

'বেশ, থ্যাঙ্ক ইউ। তোমরা সবাই এবার টিফিনে যেতে পার। টিফিনের পরে লেবু আমার সঙ্গে লাইব্রেরিতে দেখা করে যেয়ো।' বলে তিনি চলে গেলেন।
একটু পরে লেবু এসে লাইব্রেরিতে ঢুকলে তিনি বললেন, 'কাল থেকে তুমি মৌলবি সাহেবের সঙ্গে স্কুলে আসবে-কক্ষনো একলা আসবে না বলা রইল। একথা বলার জন্যই তোমাকে আসতে বলেছিলাম। আচ্ছা, এবার তুমি যেতে পারো।'

লেবু চলে গেল। এ নতুন ব্যবস্থাটা কিন্তু মৌলবি সাহেবের মোটেই মনমতো হলো না। তিনি প্রকাশ্যেই বললেন, 'আমার ঘাড়ে আবার এই ইবলিশটাকে চাপালেন কেন হেডমাস্টার মশাই?'
হেডমাস্টার মশাই হেসে বললেন, "ইবলিশ বলুন আর যা-ই বলুন, ছেলেটা কিন্তু ইন্টেলিজেন্ট। এ ধরনের ছেলেদের বলতে পারেন, 'অ্যাবাভ অ্যাভারেজ' সাধারণের ব্যতিক্রম। সুযোগ পেলে, সুপথে চালিত হলে এরাই একদিন মানুষের মতো মানুষ হয়।"

এরপর মৌলবি সাহেব আর দ্বিরুক্তি করা সঙ্গত মনে করলেন না। মৌলবি সাহেব ভিন্ন জেলার লোক। লেবুদের পাড়ায় কাজিবাড়িতে জায়গির থাকেন। এ ব্যবস্থার পর থেকে লেবুকে রোজই মৌলবি সাহেবের সঙ্গে স্কুলে আসতে হয়- পথে কারও সঙ্গে দুষ্টুমি করার তেমন সুযোগ আর হয় না।
কিছুদিন পরে স্কুলে শুরু হয়েছে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা। রুটিনমাফিক পরীক্ষার শেষের দিনে মৌলবি সাহেবের ওপর ভার পড়েছে ফোর্থ ক্লাসে গার্ড দেবার। সবাইকে বাদ দিয়ে লেবুর ওপর তাঁর সতর্ক দৃষ্টি। রাতদিন দুষ্টুমি আর বাঁদরামি করে ছেলেটি পরীক্ষায় কী করে ভালো নম্বর পায়, সে রহস্য তিনি ভেদ করবেন। নিয়মিত পড়াশোনা না করেও ভালো নম্বর পাবার সহজ পথ হলো পরীক্ষার সময় নকল করা। লেবু যা ছেলে, তার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।

আড়চোখে কিছুক্ষণ লেবুর হাবভাব লক্ষ করে মৌলবি সাহেবের মনে হলো অনুমানল্টা তাঁর যেন মিথ্যে নয়। লেবু কিছুক্ষণ পরপরই বুকপকেটটা বাঁ হাতে আঙুল দিয়ে ফাঁক করে কী যেন দেখে নিচ্ছে, তারপর আবার লেখায় মন দিচ্ছে

ব্যাপারটা দু-একবার দেখেই মৌলবি সাহেব লেবুর কাছে এসে হঠাৎ বললেন, 'দেখি তোমার জামার পকেটে কী আছে?'

লেবু আমতা আমতা করে বলল, 'ও কিছুই না স্যার।'

'কিছুই না কী রকম দেখি।' বলেই তিনি বুকপকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করলেন সিগারেটের একটা প্যাকেট। আর যায় কোথায়। মৌলবি সাহেব বলে উঠলেন, 'ছেলের এ বিদ্যেও হয়েছে দেখছি! সাধে কী আর হোপলেস বলি!'

বলেই তিনি সিগারেটের প্যাকেটটা যেমনি খুলেছেন অমনি একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। হঠাৎ তিনি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন।

ব্যাপারটা হলো- সিগারেটের খালি প্যাকেটটার ভেতর ছিল কয়েকটা আরশোলার বাচ্চা। স্কুল ছুটির পরেই পুকুরে ছিপ ফেলে মৎস্য শিকারের আয়োজন করেছে লেবু আগে থেকেই। আরশোলাগুলো হলো বড়শির টোপ। হঠাৎ মুক্তি পাওযার আশায় আনন্দে একটা আরশোলা গিয়ে আশ্রয় খুঁজতে লাগল মৌলবি সাহেবের গলার কাছে দাড়ির নিচে। সেটাকে কাবু করার আগেই দু-তিনটা ঢুকে পড়ল তাঁর পাঞ্জাবির ঢোলা আস্তিনের ভেতর। সটান ভেতরে গিয়ে উঠল। ভালো করে ব্যাপারটা বুঝবার আগেই ঊর্ধ্ববাহু মৌলবি সাহেব তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন। বে-দিশা হয়ে লাফাতে লাফাতে তিনি পড়লেন গিয়ে পাশের একটি ছেলের ডেস্কের ওপর। ডেস্কের দোয়াত-কলম সব উলটে পড়ল গিয়ে ছেলেটার কোলে। কালি পড়ে জামাকাপড়, পরীক্ষার খাতা সব একাকার হয়ে গেল। মৌলবি সাহেবের সেদিকে খেয়াল করার ফুরসত নেই। তিনি তখনও কেবলই লাফাচ্ছেন।

আসল ব্যাপার কিছুই বুঝতে না-পেরে অবাক ছেলেরা হাঁ-করে চেয়ে আছে কলম তুলে। পাশের কামরা থেকে সতুবাবু তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন তাই রক্ষা। জামার নিচে হাত গলিয়ে অতি কষ্টে তিনি আরশোলা কটা বের করলেন। এতক্ষণ পরে নিষ্কৃতি পেয়ে মৌলবি সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, 'হোপলেস, সতুবাবু, একেবারেই হোপলেস। পকেটে করে নিয়ে এসেছে কি-না তেলাপোকা। যতসব হোপলেস বে-আদব।'
সতুবাবু অতি কষ্টে হাসি চেপে বেরিয়ে গেলেন।

ছুটির পর লেবুর ডাক পড়ল হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে। তার পেছনে পেছনে গেল আর সব ছেলে। কোনো রকম ভূমিকা না করেই লেবুকে হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, 'পকেটে করে ওগুলো এনেছিলে কেন?'
নিরুত্তর লেবু নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল।
তিনি আবার তাড়া দিয়ে উঠলেন, 'কী হে, কথার জবাব দিচ্ছ না যে?'
কিছুক্ষণ পর লেবু বলে উঠল, 'আমার তো কোনও দোষ নেই, স্যার। উনিই তো ইচ্ছে করে আমার পকেট থেকে
টেনে এগুলো বের করলেন।'
'তা বুঝেছি, কিন্তু তুমি কেন ওগুলো পকেটে করে স্কুলে এনেছিলে?'
পুকুরে ছিপ ফেলবার কথাটা গোপন করে লেবু বলল, 'আরশোলা পুষব বলে ধরে এনেছিলাম স্যার।'
লেবুর কথা শুনে সবাই একযোগে হেসে উঠল।

হেডমাস্টার বললেন, 'দুনিয়ার আর কোনো জিনিস পেলে না পুষতে, তাই আরশোলা পুষতে সাধ হয়েছে। তোমাকে আমি আরশোলা পোষাচ্ছি। ঘরের ওই কোণে আরশোলা আছে। যাও, ওখানে দেয়ালমুখো দাঁড়িয়ে থাকোগে। আধঘণ্টা পর তোমার ছুটি।'

মিনিট পাঁচেক পরে মৌলবি সাহেব ছাতা হাতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তা-ই দেখে লেবুর মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি এসে গেল। হেডমাস্টারকে সে বলল, 'স্যার, এখন রোজ স্কুলে আসবার সময় মৌলবি সাহেবের সঙ্গে আসি।' 'হ্যাঁ, তা তো আমার জানাই রয়েছে।'
'কিন্তু- কিন্তু যাবার সময়...'

লেবু কী বলতে চাইছে হেডমাস্টার মশাই তা সহজেই বুঝে ফেললেন। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অতি কষ্টে হাসি চেপে তিনি বলে উঠলেন, 'বুঝেছি, বুঝেছি, আর বলতে হবে না। স্কুলে আসওয়ার সময় পাহারাধীনে এলে যাবার সময়ও সে-ব্যবস্থা হবে না কেন, এই তো বলতে চাইছ? যুক্তি যে তোমার অকাট্য তা মানতেই হবে। যাও, কিন্তু পথে দুষ্টুমি কোরো না। আর তা ছাড়া মৌলবি সাহেবকে, যাঁকে সবাই আমরা মান্যগণ্য করি, তাঁকে বিরক্ত করতে যেয়ো না।'

'আচ্ছা স্যার'- হেডমাস্টারের কথায় সায় দিয়ে লেবু বেরিয়ে গেল। কিন্তু যেতে যেতে ভাবতে লাগল মানুষ নিজে যা মনে করে সবসময় তা ঘটে কি? অঘটন তো কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঘটে না। আজকের ব্যাপারটা কি লেবুর ইচ্ছায় ঘটেছে? লেবু কি চেয়েছিল মৌলবি সাহেব তাকে সন্দেহ করবেন আর পকেট থেকে আরশোলার বাক্সটা টেনে বের করবেন? অথবা তিনি কি মনে করেছিলেন ওটা খুললেই এমন বিপদ ঘটবে?

লেবুদের বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে একটা ছোটো খাল পার হতে হয়। খাল পেরিয়েই কুমোরপাড়া। পাড়াটার গাঁ-ঘেঁষে চলে গেছে পায়ে-চলা সরু পথ। সময় বাঁচানোর জন্য সোজা পথে যেতে হলে এটাই সে পথ। মৌলবি সাহেবের সঙ্গে এ পথেই সেদিন লেবু যাচ্ছিল স্কুলে। যেতে যেতে তার চোখে পড়ল একটা কাঠবিড়ালি। কাঠবিড়ালিটা মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে কী যেন মুখে দিচ্ছিল। লেবুর জন্য সুবর্ণ সুযোগ। মুহূর্তে সে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল। পকেট হাতড়ে দেখল, রবারের ছোট গুলতিটা ঠিকই আছে, মাটির তৈরি গুলিও আছে দু-তিনটা। কাঠবিড়ালি শিকারের এমন সুযোগ হেলায় হারানো যায় না। মৌলবি সাহেবের দৃষ্টি এড়িয়ে এক মুহূর্তে সে তার গুলতিটার সদ্ব্যবহার করে ফেলল।

আমগাছটার ঠিক পাশেই স্তূপাকারে সাজানো রয়েছে কুমোরদের অনেকগুলো মেটে হাঁড়ি-পাতিল। বেচারা লেবুকে হতাশ করে দুষ্টু কাঠবিড়ালি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল গিয়ে আমগাছের ডগায়; এদিকে লেবুর লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলিটা লাগল গিয়ে একটা হাঁড়ির গায়ে। গাছের নিচে সেই হাঁড়িটা যেই ভেঙেছে অমনি স্তূপের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল আরো পনেরো-বিশটা হাঁড়িপাতিল, সবকটাই ভেঙে চুরমার। পলকে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেল। আওয়াজ হলো যেন একটা বোমা ফাটল এইমাত্র।

কীসে কী হলো মৌলবি সাহেব কিছুই বুঝতে পারলেন না। পিছনে চেয়ে দেখলেন, লেবু ততক্ষণে হাওয়া। কুমোরবাড়ি থেকে চিৎকার করে ছুটে এল আধপাগলাগোছের একটা লোক। এসে সামনেই পেল মৌলবি সাহেবকে। হাঁড়ি ফাটার শব্দে হতভম্ব হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটা এসেই তাঁর লম্বা কোর্তার খুঁট টেনে ধরল। বলল, 'চাইয়া দেখবার লাগছেন কী, দাম না-দিলে যাইতে দিমু না।'

মৌলবি সাহেব আরও হতভম্ব। তিনিও রেগে বলে উঠলেন, 'কাপড় ছেড়ে কথা বলো বে-আদব কাঁহাকা। তোমার হাঁড়ি কি আমি ফাটিয়েছি যে দাম দেবো?'

কিন্তু কার যুক্তি কে শোনে? আধ-পাগলা লোকটা নাছোড়বান্দা। বলে উঠল, 'একটা ছেইলারে লইয়া রোজ-রোজ আপনে স্কুলে যায়েন না এহান দিয়া? হেই ছেইলাডার এই কাম। হেই তো পাছের থনে দৌড় মারছে, দেখছি সব।'

পেছনের একটা বাড়ির আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে লেবু সব দেখছিল। একেই বলে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। অবশেষে মৌলবি সাহেব অতগুলো হাঁড়ির দাম নগদ দিতে না পেরে হাতের ছাতাটা বাঁধা রাখলেন। ছাতা বাঁধা রেখে স্কুলের পথ ধরলেন। বললেন, দু দিন পর মাইনে পেলে ছাতাটা ছাড়িয়ে নেবেন।

শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সকল ঋতুতে মৌলবি সাহেবের হাতে থাকত ওই একটা ছাতা, কাঁধে হলদে সুতোর বুটাতোলা বড়ো একখানা রুমাল। প্রয়োজনের সময় যা ব্যবহৃত হতো জায়নামাজ হিসেবে। বলতে গেলে এ দুটি বস্তু ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। আজই প্রথম দেখা গেল স্কুলের পথে মৌলবি সাহেবের কাঁধে রুমালখানা আছে কিন্তু হাতে ছাতাটি নেই।

এদিকে ভিন্ন পথে এসে লেবু কিন্তু চুপচাপ বসে ছিল তার ক্লাসে। বসে বসে মুহূর্ত গুনছিল কোন সময় তার ডাক পড়বে হেডমাস্টারের কামরায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, ডাক পড়ল না। ফারসি পড়াতে ক্লাসে এসে মৌলবি সাহেব নিজেও কিছু বললেন না। স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে আজ বড়ো বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

লেবুর মনটা হঠাৎ ভরে গেল মৌলবি সাহেবের প্রতি সহানুভূতিতে। অনুতাপও কম হলো না তার। বাড়ি গিয়েও সে মনে শান্তি পেল না।
পরের দিন।

স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। লেবুর পা নড়ছে না আজ কাজিবাড়ি গিয়ে মৌলবি সাহেবের সামনে দাঁড়াতে। তবু এক-পা দু-পা করে নিতান্ত অপরাধীর মতো সে এগিয়ে গেল। অপরাধীর মতোই সে কাছারি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল, বুড়ো কাজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন মৌলবি সাহেব। বলছেন, 'মাস্টারি কাজ আর ভালো লাগছে না। এর চেয়ে গাঁয়ে গিয়ে চাষবাস করাও ভালো। কাল বাড়ির চিঠি পেলাম- ছেলেপিলেরা ভুগছে অসুখে-বিসুখে। তার ওপর আবার বিপদ দেখুন, বাপদাদার আমলের সামান্য একটু জোতজমি ছিল, তা-ও নিলামে উঠতে চলেছে বাকি খাজনার দায়ে। এই চাকরি করে দূরে থেকে কত দিক আর সামলাব!'

বলতে বলতে বাইরে এসে দেখলেন, লেবু দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বললেন, 'আজ আর স্কুলে যাব না লেবু। মনটা
তেমন ভালো নেই। এই দরখাস্তটা দিয়ো হেডমাস্টার মশাইকে।'

হঠাৎ লেবু বলে উঠল, 'আমাকে মাফ করুন স্যার। আমি আর দুষ্টুমি করব না।'
মৌলবি সাহেব লেবুকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, 'না লেবু, তুমি তো ইচ্ছা করে কোনো অন্যায়
করনি- সবই ঘটনাচক্রে ঘটে গেছে। তোমরা ভালো হবে, মানুষ হবে, এই তো আমাদের কামনা।'
লেবু যেন মৌলবি সাহেবের কাছ থেকে সেদিন এক নতুন দীক্ষা গ্রহণ করল।

common.content_added_by

লেখক-পরিচিতি

33
33

মোহাম্মদ নাসির আলী ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের ধাইদা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবনে 'দৈনিক ইত্তেহাদ' পত্রিকার শিশু বিভাগের পরিচালকের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি 'নওরোজ কিতাবিস্তান' নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- 'মণিকণিকা', 'শাহী দিনের কাহিনী', 'ছোটদের ওমর ফারুক', 'বোকা বকাই', 'লেবু মামার সপ্তকাণ্ড' ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব

33
33

স্কুলের ফোর্থ ক্লাসের ছাত্র লেবু। শিক্ষক ও বন্ধুদের কাছে সে দুষ্টের শিরোমণি হিসেবে পরিচিত। নানা ধরনের উৎপাত ও দুষ্টুমির কারণে সবাই তার নাগালের বাইরে থাকার চেষ্টা করত। একবার চণ্ডীতলার এক পাঠশালার দেয়ালে আপত্তিকর ছড়া লেখার অভিযোগ পেয়ে হেডমাস্টার সব ছাত্রকে ডেকে জানতে চাইলেন, কে এই কাজ করেছে। লেবু দাঁড়িয়ে সেই অন্যায় কাজের দায় স্বীকার করল। তার এই সৎসাহস দেখে হেডমাস্টার খুশি হলেন। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, সে যেন আর একা একা স্কুলে না আসে। মৌলবি সাহেবের সঙ্গেই প্রতিদিন স্কুলে আসার নির্দেশ দিলেন। লেবু পড়ল বিপদে। মৌলবি সাহেবের সঙ্গে আসার পথে সে কারো সঙ্গে দুষ্টুমি করার সুযোগ পেত না। তবে একদিন ঘটল অঘটন। কুমোরপাড়ার পাশ দিয়ে যাওয়া সময় লেবুর চোখে পড়ল এক কাঠবিড়ালি। কাঠবিড়ালিটি শিকার করতে গেলে ভেঙে পড়ল পনেরো-বিশটি হাঁড়ি। এ অবস্থা দেখে লেবু দৌড়ে পালাল। কিন্তু কুমোরপাড়া থেকে এক লোক এসে ধরল মৌলবি সাহেবকে। হাঁড়ির দাম হিসেবে বেচারা মৌলবি সাহেব বাঁধা রাখলেন নিজের ছাতাটা। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে লেবুর অনুতাপ হলো। পরদিন সে মৌলবি সাহেবের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইল। মৌলবি সাহেব তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শিক্ষকের এই মহানুভবতা লেবুকে বদলে দিল।

নিছক আনন্দ যেমন মানুষকে বিপদে ফেলে, ক্ষমা এবং আন্তরিকতা তেমন মানুষকে সুপথে নিতে পারে।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

34
34

গরহাজির - অনুপস্থিত।
ফোর্থ ক্লাস - সেকালে ফোর্থ ক্লাস বলতে এখনকার সপ্তম শ্রেণি বোঝায়।
মৌলবি - ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞ, মুসলিম পণ্ডিত।
প্রমাদ - বিপদের আশঙ্কা।
উৎপাত - উপদ্রব।
অবান্তর - অপ্রাসঙ্গিক, মূল প্রসঙ্গের বহির্ভূত।
হোপলেস - আশাহীন, নির্বোধ। ইংরেজি Hopeless.
কাঁহাকা - কোথাকার।
ইবলিশ - শয়তান।
ইন্টিলিজেন্ট - বুদ্ধিমান, জ্ঞানী।
দ্বিরুক্তি - দ্বিতীয়বার উক্ত, দ্বিতীয় দফায় উল্লেখ।
জায়গির - বিনা খরচে কোনো পরিবারে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। -
হাফ-ইয়ার্লি - অর্ধ-বার্ষিক। ইংরেজি Half-yearly.
টোপ - বরশিতে গাঁথা মাছের খাদ্য।
আন্তিন - কোট বা জামার হাতা।
বে-দিশা - দিশাহারা।
নিষ্কৃতি - মুক্তি, অব্যাহতি।
গুলতি - মাটির ঢিল ছোড়ার ধনুকবিশেষ।
মেটে - মাটি দ্বারা নির্মিত।
উদোর পিণ্ডি - বুধোর ঘাড়ে - একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো।
কাছারি ঘর - বিচারালয়, অফিস, বৈঠক ঘর।
দরখাস্ত - আবেদন, আরজি।
দীক্ষা - উপদেশ, শিক্ষা।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion